সাবেক এমপি আবু জাহির শুধু নিয়েছেন, দেননি কিছুই হবিগঞ্জ হাই স্কুল এন্ড কলেজকে

Posted by

ছালেহ আহমদ চৌধুরী, হবিগঞ্জ, শিক্ষা প্রতিদিন: সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু জাহিরের বাসা থেকে প্রায় ৫০ গজ দূরে হবিগঞ্জ হাই স্কুল এন্ড কলেজ। আবু জাহির ও স্ত্রী আলেয়া প্রায় ১৬ বছর এই স্কুলের গভর্নিং বডির সভাপতি ছিলেন। নানা সুযোগ থাকা সত্বেও এই স্কুলে লাগেনি উন্নয়নের ছিটেফোটা। বরং ক্ষমতার দাপটে এই স্কুলের সম্পদের যতেচ্ছা ব্যবহার করেছেন। চাকুরী দিয়েছেন বোন ভাগ্নে নাতিসহ দলীয় নেতার মেয়েকে। শিক্ষক কর্মচারীদের ব্যবহার করেছেন রাজনৈতিক কাজে। অনুসন্ধানে বের হয়েছে আবু জাহির দম্পত্তির ১৬ বছরের নানা আমলনামা। হবিগঞ্জ শহরের প্রানকেন্দ্র টাউন হল রোডে ১৯১৩ সালে প্রতিষ্টিত হয় হবিগঞ্জ হাই স্কুল। আবু জাহির এই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র। স্কুল সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে দ্বিতীয় বারের মতো এমপি নির্বাচিত হওয়ার পরেই স্কুল গর্ভনিং কমিটির সভাপতির দায়িত্ব নেন তিনি। আবু জাহিরের চোখ পড়ে ১০ রুমের প্রধান শিক্ষকের বাসভবনের উপর। তৎকালিন প্রধান শিক্ষক নূরুল ইসলামকে অনেকটা জোর করেই বের করে দেয়া হয় বাসা থেকে। জানুয়ারি ২০১৪ হতে ডিসেম্বর ২০২০ইং পর্যন্ত বিশাল এ বাসাটি জাহির ভাড়া নেন মাত্র তিন হাজার টাকায় । ফ্লোরে টাইলসসহ অন্যান্য কাজের নামে স্কুলের তহবিল থেকে নেয়া হয় প্রায় ১৫ লাখ টাকা। পাশেই আবু জাহিরের নিজস্ব ৬ তলা বাসা থাকা সত্বেও ভাড়ার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পরই প্রধান শিক্ষকের বাসাটি স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর না করে তার ছোট ভাই বদরুল আলম ও আল আমিনকে বাসায় তুলেন। লাইনের গ্যাস ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা সম্বলিত এ ধরনের বাসা ভাড়া যেখানে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা সেখানে দেড় হাজার টাকা বাড়িয়ে ২০২১ – ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ভাড়া ধরা হয়েছে মাত্র সাড়ে ৪ হাজার টাকা। সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়,বাসাটি আবু জাহিরের ভাইয়েরা বসবাস করায় গত ২ ও ৪ আগষ্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতা বাসায় দুই দফা হামলা চালায়। ভাংচুর, লুটপাটের ফলে বাসভবনটি এখন অনেকটা কংকাল। বাসার উন্নয়নে খরচ দেখানো ১৫ লাখ টাকার মধ্যে ভাড়া থেকে গত জুলাই পর্যন্ত ভাড়া আদায় হয়েছে মাত্র ৪ লাখ ৯০ হাজার ৫ শ টাকা। সূত্র আরো জানায়, তৎকালিন প্রধান শিক্ষক আবু লেইছ নিজের চাকুরীর মেয়াদ বৃদ্ধি ও মেয়ে সুর্বনা নার্গিসকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগসহ নানা সুযোগ সুবিধা আদায় করতে স্কুল মার্কেটের ৫টির মধ্যে ২টি দোকান কোটা সাবেক এমপির ভাই বদরুল আলম ও আল আমিনের নামে বরাদ্দ দেয়া হয়। ওই দুই দোকান ভাড়া দিয়ে আবু জাহিরের দুই ভাই মাসে প্রায় অর্ধ লক্ষ টাকা করে আয় করছেন। তবে স্কুল কর্তৃপক্ষ দোকান প্রতি ভাড়া পাচ্ছে মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকা।

চাকুরীতে আবু জাহিরের স্বজনপ্রীতিঃ স্কুলের সম্পদ ব্যবহারেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না আবু জাহির। ২০১০ সালে স্কুলটিকে কলেজে উন্নীত করা হয়। এ সুযোগে আবু জাহির তার ছোট বোন খোদেজা আক্তার, নাতি সাইদুর রহমান, আওয়ামী লীগ নেতা আফিল উদ্দিনের কন্যা রওশন আরা বেগম, সেলিনাকে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই কলেজের খন্ডকালিন প্রভাষক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এর আগে খোদেজা ওই স্কুলের লাইব্রেরীয়ান পদে ছিলেন। সনদ বানিজ্যসহ বিভিন্ন অভিযোগে সরকারের বন্ধ করে দেয়া দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ দিয়ে খোদেজা স্কুলে চাকুরি নেন। জানা যায়, সার্টিফিকেট নিয়ে তৎকালিন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও সিলেট শিক্ষা বোর্ড আপত্তি তুলে। আবু জাহিরের হস্তক্ষেপে তা ধামাচাপা পড়ে। খোদেজা স্বীকার করেছেন লাইব্রেরী বিষয়ে ডিপ্লোমা সনদটি দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের। বৃন্দাবন সরকারি কলেজ থেকে বিএ পাশ করার পর সিলেট এমসি কলেজ থেকে মাষ্টার্স সম্পন্ন করেছেন। একই বছর নিয়োগপ্রাপ্ত ইংরেজি শিক্ষক বদরুজ্জামান তালুকদার, গনিত শিক্ষক সাবিনা চৌধুরী, সেলিনা আক্তারের বিএড এর সনদও দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের। শিক্ষক সাবিনা,বদরুজ্জামান ও সেলিনা বলেন, তারা দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ নিয়ে স্কুলে যোগদান করলেও পরবর্তিতে ঝামেলা দেখা দেয়ায় ‘সীমান্তিক ট্রেনিং সেন্টার’ থেকে ২০১৮ সালে বিএড কোর্স শেষ করেন। আইসিটি শিক্ষক পদে চাকুরী পাইয়ে দেন আবু জাহির ভাগনা দুলালকে। কম্পিউটার শিক্ষক হলেও তিনি সহকর্মীদের কাছে ‘নেতা’ হিসেবে পরিচিত। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও কর্মচারির সাথে আলাপ করে জানা গেছে, সরকার পরিবর্তন হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত দুলাল শিক্ষকের দায়িত্বের চেয়ে রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ড নিয়ে বেশি ব্যস্ত ছিলেন। মিজান নামে একজন পিয়ন স্কুল থেকে বেতন নিলেও দিনরাত আবু জাহিরের বাসায় কাজ করতেন বলে জানা গেছে। শিক্ষিকা সাবিনা চৌধুরী উপজেলা মহিলা লীগের নেত্রী। শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন না করে জেলা মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক স্ত্রী আলেয়া জাহিরের সাথে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে বেশি সময় কাটাতেন। স্কুলের আয় ব্যয়ে কোন লাগাম নেই। গত ১০ বছর ধরে অডিট হচ্ছে না জানান শিক্ষকরা।

ছাত্র জনতার আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও ভাড়াটে লোকজন,আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র এনে স্কুলের অভ্যন্তরে রাখেন। বিক্ষুব্ধ জনতা স্কুলের মাঠে থাকা প্রায় ১০টি মোটর সাইকেল পুড়িয়েছে। বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্রদের সহযোগিতায় রক্ষা পায় একাডেমিক ভবনগুলো। ঘুরে দেখা গেছে তিনযুগ আগে যেমন ভগ্নদশা ছিল আজো একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে মানুষ গড়ার প্রতিষ্ঠানটি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*