কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাক হোল নিয়ে পবিত্র কোরআনে বিশেষভাবে ঈরশাদ আছে

Posted by

নুরুন্নাহার হীরা, সহ-সম্পাদক: ব্লাক হোল বা কৃষ্ণ গহবর ২০১৯ সালের ১০ ই এপ্রিল মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার ইভেন্ট হরিজন টেলিস্কোপদিয়ে ৫৪ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এম৮৭ গ্যালাক্সির কেন্দ্রের এই পোস্টের ব্লাক হোলের ছবিটি তুলেছেন। মূলত পৃথিবীর মানুষের তোলা ব্লাক হোলের এটিই প্রথম ছবি।

মহাকাশে ব্লাক হোল আসলে কি ? ইসলাম ধর্মের পবিত্র ধর্ম গ্রন্থে ব্লাক হোলের ইঙ্গিত সম্পর্কে আজকের আলোচনা। ব্লাক হোল সম্পর্কে মানুষ জেনেছে মাত্র কিছুদিন আগে। কিন্ত প্রায় সাড়ে ১৪০০ শত বৎসর পূর্বেই মহাকাশ ও জগত সমূহের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ পবিত্র আল কোরআনে ব্লাক হোলের উদাহরণ দিয়ে বলেন,”আমি শপথ করছি নক্ষত্র সমূহের পতিত হওয়ার স্থানের। “নিশ্চয় এটা এক মহা শপথ-যদি তোমরা জানতে।”[সূরা আল-ওয়াকেহা,আয়াতঃ ৭৫ ও ৭৬]

ব্ল্যাকহোল কী? মহাকাশে এমন কিছু তারকা বা নক্ষত্র আছে, যারা এমন শক্তিশালী মহাকর্ষ বল তৈরী করে যে এটি তার কাছাকাছি চলে আসা যে কোন বস্তুকে একেবারে টেনে নিয়ে যায়, হোক তা কোন গ্রহ, ধুমকেতু বা স্পেসক্রাফট, তা-ই ব্ল্যাক হোল। পদার্থবিজ্ঞানী জন হুইলার এর নাম দেন ‘ব্ল্যাক হোল’।এই তারকাদের অস্বাভাবিক আকার, ভর ও ঘনত্ব থাকে, আর এর জন্যে এই সব তারকা থেকে নির্গত আলো বাইরে আসতে পারে না। সহজ ভাষায় বলতে গেলে- যখন একটি তারকার জীবনকাল শেষ হয়ে যায়, সেই মুহূর্তে তার অভিকর্ষ শক্তি এতই প্রবল হয় যে আলো ওখান থেকে বের হতে পারে না। আর এই ঘটনা তখনই ঘটে যখন একটি তারকার জীবনকাল অর্থাৎ তার নির্দিষ্ট জ্বালানি শেষ হয়ে যায়। তারকাটি পরিণত হয় ব্ল্যাক হোলে। এভাবেই একটি ব্ল্যাক হোলের সৃষ্টি হয়।ব্ল্যাকহোল-এর জন্ম কীভাবে, কৃষ্ণগহ্বরের জন্ম ইতিহাস অনেকটা কবিতার মতো। একটি তারার মৃত্যু থেকে জন্ম নেয় একটি কৃষ্ণগহ্বর। বিজ্ঞানীদের মতে- সব চেয়ে ছোট ব্ল্যাকহোলটির জন্ম ঠিক এই মহাবিশ্বের জন্মের সময়। একটি নক্ষত্রের নির্দিষ্ট জ্বালানি নিঃশেষ হয়ে গেলে এর মৃত্যু ঘটে। যতক্ষণ পর্যন্ত এর অভ্যন্তরীণ হাইড্রোজেন গ্যাস অবশিষ্ট থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত এর ভিতরে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া চলতে থাকে। হাইড্রোজেন শেষ হয়ে গেলে এর কেন্দ্রীয় মূলবস্তু সংকুচিত হতে থাকে। এভাবে একটি তারার মৃত্যু হয়।ব্ল্যাকহোলে রয়েছে শক্তিশালী মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র।

প্রত্যেক ব্ল্যাকহোলের চারদিকে একটি সীমা আছে যেখানে একবার ঢুকলে আর বের হওয়া যায় না। এইভাবেই মহাকাশের মহাবিস্ময় হয়ে বেঁচে আছে ব্ল্যাকহোল। একে নিয়েই চলছে বিজ্ঞানের নিরন্তর চর্চা। আলোকে গিলে খাওয়া এই মহাকাশীয় দানবকে নিয়ে তাই আজও কৌতূহলের শেষ নেই।

কৃষ্ণগহ্বর গবেষণার ইতিহাস: ব্ল্যাকহোল হলো বিপুল পরিমাণ ভর বিশিষ্ট কোন বস্তু, যার মহাকর্ষের প্রভাবে আলোক তরঙ্গ পর্যন্ত পালাতে পারে না- এ ধারণা সর্বপ্রথম প্রদান করেন ভূতত্ত্ববিদ জন মিচেল (John Michell)। ১৭৯৬ সালে গণিতবিদ পিয়েরে সিমন ল্যাপলেস একই মতবাদ প্রদান করেন তাঁর ‘Exposition du systeme du Monde‘ বইয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণে।১৯১৬ সালে আইনস্টাইন তার “জেনারেল রিলেটিভিটি তত্ত্ব ” দিয়ে ধারনা করেন ব্ল্যাকহোল থাকা সম্ভব। আর ১৯৯৪ সালে এসে নভোচারীরা প্রমাণ করেন আসলেই ব্ল্যাকহোল আছে। এটি কোন সায়েন্স ফিকশন নয়। জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল শোয়ার্জস্কাইল্ড ১৯১৬ সালেই দেখান, যেকোন তারকা ব্ল্যাকহোলে পরিণত হতে পারে। কতো বড় এই ব্ল্যাকহোল?ব্ল্যাকহোল ছোট হতে পারে আবার বড়ও হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে ক্ষুদ্রতম ব্ল্যাকহোল একটি পরমাণুর সমান হতে পারে। এই জাতীয় ব্ল্যাকহোলগুলো অনেক ক্ষুদ্র কিন্তু তাদের এক একটার ভর হতে পারে বিশাল কোন পর্বতের সমান। অন্য এক ধরনের ব্ল্যাকহোলকে বলা হয় “স্টেলার” বা “নাক্ষত্রিক”। এর ভর আমাদের সূর্যের ভর এর চেয়েও ২০ গুণ বেশি হতে পারে।খুব সম্ভবত অনেক অনেক বেশি ভরেরও নক্ষত্র রয়েছে পৃথিবীর ছায়াপথে। আর পৃথিবীর এই ছায়াপথকে বলা হয় “মিল্কিওয়ে”। সবচেয়ে বৃহৎ ব্ল্যাকহোলকে বলা হয় “সুপারমেসিভ”। বিজ্ঞানীরা বলছেন যদি আমাদের এই পৃথিবী ব্লাক হোলে প্রবেশ করে তাহলে মূহুর্তের মধ্যেই সংকুচিত হয়ে একটি ছোট মারবেল পাথরের আকার ধারণ করবে।আল-কোরআনে “ব্লাক হোল”এর নিদর্শনঃআল-কোরআনে সরাসরি এটির নাম উল্লেখ করা হয়নি বটে। কিন্তু মহান আল্লাহ তাঁর কিতাবে এমন একটি বিশেষ সৃষ্টি সম্পর্কে শপথ করেছেন এবং এমন কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা ব্যক্ত করেছেন যার সাথে সম্প্রতি আবিষ্কৃত “ব্ল্যাকহোল” এর বৈশিষ্ট্যের সাথে মিল দেখলে সত্যিই বিস্মিত হতে হয়।

প্রায় ১৪৫০ বছর পূর্বে আরবের মরুভূমিতে তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে বর্বর জাতির উপর নাযিলকৃত আল-কোরআনে প্রদত্ত বিজ্ঞান বিষয়ক ঐশী তথ্যগুলোর যে অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায় তা প্রতিটি চিন্তাশীল মানুষকে ভাবিত ও অভিভূত না করে পারে না।আল-কোরআনের সূরা ওয়াকিয়াহর ৭৫ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ফালা – উক্বছিমু বিমাওয়া- ক্বি‘ইন নুজূম।অর্থ:- আমি শপথ করছি নক্ষত্রসমূহের পতিত হওয়ার স্থানের।কোরআনে( ৮১:১৫) আল্লাহ বলেন, ফালা – উক্বছিমু বিল খুন্নাছিল।অর্থ- আমি শপথ করি – গোপন হয়ে যাওয়া তারকা বা নক্ষত্রের ।কোরআনের (৮১:১৬) আয়াতে আছে, জাওয়া- রিল কুন্নাছ।অর্থ-যা অদৃশ্য হয়ে প্রত্যাগমণ করে।কোন তারকা কৃষ্ণগহ্বরের খুব কাছাকাছি এলে তার নিকটতম ও দূরবর্তী অংশে মহাকর্ষীয় আকর্ষণের পার্থক্যের জন্য তারকাটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এর অবশিষ্টাংশ থেকে যে সমস্ত বায়বীয় পদার্থ নির্গত হয় সবই গিয়ে পড়ে ঐ কৃষ্ণগহ্বরে। সুতরাং কোরআনের (৫৬:৭৫) নং আয়াতে নক্ষত্রসমূহের পতিত হওয়ার স্থান বলতে যে ব্ল্যাকহোল-কেই বোঝান হয়েছে তা সহজেই বুঝে নেয়া যায় এবং উপরে বর্ণিত আয়াত ও অন্যান্য আরো কিছু আয়াত ব্লাক হোলের বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে।

ব্ল্যাকহোল হোল সম্পর্কে উইকিপিডিয়া বলে,কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাক হোল মহাবিশ্বের অস্তিত্ব ও প্রকৃতি বিষয়ক একটি বহুল প্রচলিত ধারণা। এই ধারণা অনুযায়ী কৃষ্ণগহ্বর মহাবিশ্বের এমন একটি বস্তু যা এত ঘন সন্নিবিষ্ট বা অতি ক্ষুদ্র আয়তনে এর ভর এত বেশি যে এর মহাকর্ষীয় শক্তি কোন কিছুকেই তার ভিতর থেকে বের হতে দেয় না, এমনকি তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণকেও (যেমন: আলো) নয়। প্রকৃতপক্ষে এই স্থানে সাধারণ মহাকর্ষীয় বলের মান এত বেশি হয়ে যায় যে এটি মহাবিশ্বের অন্য সকল বলকে অতিক্রম করে। ফলে এ থেকে কোন কিছুই পালাতে পারে না। অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রথম তৎকালীন মহাকর্ষের ধারণার ভিত্তিতে কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্বের বিষয়টি উত্থাপিত হয়।সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুসারে, কৃষ্ণগহ্বর মহাকাশের এমন একটি বিশেষ স্থান যেখান থেকে কোন কিছু, এমনকি আলো পর্যন্ত বের হয়ে আসতে পারে না। এটা তৈরি হয় খুবই বেশি পরিমাণ ঘনত্ব বিশিষ্ট ভর থেকে। কোন অল্প স্থানে খুব বেশি পরিমাণ ভর একত্র হলে সেটা আর স্বাভাবিক অবস্থায় থাকতে পারে না। আমরা মহাবিশ্বকে একটি সমতল পৃষ্ঠে কল্পনা করি। মহাবিশ্বকে চিন্তা করুন একটি বিশাল কাপড়ের টুকরো হিসেবে এবং তারপর যদি আপনি কাপড়ের উপর কোন কোন স্থানে কিছু ভারী বস্তু রাখেন তাহলে কি দেখবেন? যেইসব স্থানে ভারি বস্তু রয়েছে সেইসব স্থানের কাপড় একটু নিচু হয়ে গিয়েছে। এই একই বাপারটি ঘটে মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে। যেসব স্থানে ভর অচিন্তনিয় পরিমাণ বেশি সেইসব স্থানে গর্ত হয়ে আছে। এই অসামাণ্য ভর এক স্থানে কুন্ডলিত হয়ে স্থান-কাল বক্রতার সৃষ্টি করে। প্রতিটি গালাক্সির স্থানে স্থানে কম-বেশি কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিতের কথা জানা যায়। সাধারণত বেশীরভাগ গ্যালাক্সিই তার মধ্যস্থ কৃষ্ণগহ্বরকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণয়মান।

কৃষ্ণগহ্বর শব্দের অর্থ কালো গর্ত। একে এই নামকরণ করার পেছনে কারণ হল এটি এর নিজের দিকে আসা সকল আলোক রশ্মিকে শুষে নেয়। কৃষ্ণগহ্বর থেকে কোন আলোক বিন্দুই ফিরে আসতে পারে না ঠিক থার্মোডায়নামিক্সের কৃষ্ণ বস্তুর মতো।অনেকদিন পর্যন্ত কৃষ্ণগহ্বরের কোন প্রত্যক্ষ দর্শন পাওয়া গিয়েছিল না, কারণ এ থেকে আলো বিচ্ছুরিত হতে পারে না যেকারণে একে দেখা সম্ভব নয়, কিন্ত এর উপস্থিতির প্রমাণ আমরা পরোক্ষভাবে পেয়েছিলাম। কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিতের প্রমাণ কোন স্থানের তারা নক্ষত্রের গতি এবং দিক দেখে পাওয়া যায়। মহাকাশবিদগণ ১৬ বছর ধরে আশে-পাশের তারামন্ডলীর গতি-বিধি পর্যবেক্ষণ করে গত ২০০৮ সালে প্রমাণ পেয়েছেন অতিমাত্রার ভর বিশিষ্ট একটি কৃষ্ণগহ্বরের যার ভর আমাদের সূর্য থেকে ৪ মিলিয়ন গুন বেশি এবং এটি আমাদের আকাশগঙ্গার মাঝখানে অবস্থিত।১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালে লাইগো সংগঠন মহাকর্ষীয় তরঙ্গের প্রথম প্রত্যক্ষ সনাক্তকরণের ঘোষণা দেয়, যা ছিল দুটি কৃষ্ণগহ্বরের একত্রীভবনের প্রথম পর্যবেক্ষণ।৭ ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত ১১ টি মহাকর্ষীয় তারঙ্গিক ঘটনা পর্যবেক্ষিত হয়েছে যার মাঝে ১০ টি ঘটনা কৃষ্ণগহ্বরের একত্রীভবনের ফলে এবং ১ টি ঘটনা দ্বৈত নিউট্রন তারা একত্রীভবনের ফলে সৃষ্ট। ২০১৭ সালে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ দ্বারা মেসিয়ে ৮৭ ছায়াপথের কেন্দ্রে অবস্থিত অতিভারী কৃষ্ণগহ্বরের পর্যবেক্ষণের পর, দীর্ঘ বিশ্লেষণ শেষে ১০ এপ্রিল ২০১৯ সালে প্রথমবারের মত একটি কৃষ্ণবিবর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের প্রত্যক্ষ চিত্র প্রকাশিত হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*