আমি ঢাকাতে থাকি বেশ কিছুদিন হল, মাইসা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে সিএসসিতে ভর্তি হয়েছে, হঠাৎ করে ঢাকায় আসা নির্দিষ্ট কোন জায়গায় উঠতে পারেনি তাই খালামণির সঙ্গে থাকতে হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রিয় বান্ধবী রানী বিদেশ থেকে দেশে এসেছে। তার ডাককে অস্বীকার করতে পারেনি। তাই হঠাৎ সিদ্ধান্ত গ্রামের বাড়িতে ঘুরে আসি, চটকরে মাইসাও রাজি হয়ে গেল। সকালে ঘুম থেকে উঠি উঠি করছে মন কিন্তু উঠতে চাইছে না, আলসেমি করতে করতে সকাল নটা বেজে গেল, তড়িঘড়ি করে ব্যাগ গুছিয়ে মাইসা ও আমি বেরিয়ে পড়লাম। ইচ্ছে আছে রানীর সঙ্গে কিছুদিন থাকব এই সপ্তাহ খানেক, ব্যাগটা বেশ ভারী হয়েছিল পোশাক-আশাকের ব্যাপার মেয়েদের ব্যাগ বলে কথা, মাইসার কোন চিন্তা নেই।সে যাচ্ছে তার বাবার বাড়িতে এজন্য তার ব্যাগ ছোট। ঢাকার জ্যাম সম্পর্কে কমবেশি সবারই ধারনা আছে সেজন্য কোথাও যেতে গেলে মিনিমাম দু ঘন্টা আগে বেরোতে হয় সেখানে আমরা দুজন কোন পরিকল্পনা ছাড়াই বেরোলাম। প্রায় দু’ঘণ্টা পর গুলিস্তান পৌছালাম। টিকিট কাউন্টারের সামনে যেতেই একটা লোক বসে আছেন দু-পা ছড়িয়ে, হঠাৎ করেই আমাদের দুজনকে দেখে বলল এটাই আপনাদের গাড়ি উঠে পড়ুন উঠে পড়ুন। হঠাৎ করে লোকটার কথা শুনে খুব একটা অসহ্য লাগে। লোকটা কিভাবে জানল আমরা বাসের টিকিট কেটেছি কিনা আশ্চর্য কি গায়ে পরা লোকরে বাবা, হঠাৎ কেন জানি মেজাজটা খিটখিটে হয়ে গেল, ঝাঁজালো সুর দিয়ে লোকটাকে বলে উঠলাম এই আপনি কিভাবে জানেন এটা আমাদের গাড়ি, আরে আমরা তো টিকিটই কাটিনি,লোকটা আমতা আমতা করে বলে উঠলো না মানে মনে হয়েছিল এটাই বোধ হয় আপনাদের গাড়ি। দুজনে ঠিকঠাক করে বসে পড়লাম, কিছুক্ষণ পরে দেখলাম সেই গায়ে পরা লোকটা বাসের ভেতর উঠছে কেমন যেন একটা অস্বস্তিতে ভরে গেল মন, এই লোকটার সঙ্গে সারা রাস্তা যেতে হবে আমাদের, মাইসা কোথাও যেতে গেলে হেডফোন কানে দিয়ে গান শুনতে শুনতে যায়, ওর সঙ্গে বোবার মতো বসে থেকে যেতে হয় কারণ ওতো নিজেই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গান শুনতে শুনতে যায় আর আমি পাশের মানুষটা বোবার মতো বসে থাকে একটা অসহ্য ব্যাপার তাইনা।

আমরা যে সিটে বসা তার ঠিক উল্টো পাশে ওই গায়ে পড়া ছেলেটি বসেছিল, সাথে একটা ছেলেও ছিল, দুজন খুব বকবক করছিল, মাঝেমধ্যে আড়চোখে আমাদের দেখছিল, অনেক সময় চোখে চোখ পড়ে গেছে হঠাৎ করেই চোখ সরিয়ে নিয়ে যাওয়া, মাইসাকে দুবার ডাকলাম। ও বলল তুমি ঘুমাও আমাকেও ঘুমাতে দাও, আমার মাথা ব্যথা করবে প্লিজ আমাকে ডেকো না, কি আর করা চুপচাপ বসে রইলাম কিছুক্ষণ তারপর আবার মোবাইল কিছুক্ষণ গান শুনি, কিছুক্ষণ ফেসবুক দেখি, কিছুক্ষণ কারো সঙ্গে মোবাইলে চ্যাটিং এভাবেই সময় পার করছি। মাওয়াঘাট চলে এলাম এখন বাস থেকে নামার পালা, নামার কথা মনে হতেই মনে পড়ল এত বড় লাগেজ আমি কিভাবে টেনে নিবো, আশেপাশে কোন কুলিও দেখছি না, মাইসা নেমে ঢ্যাংঢ্যাং করে হাঁটা শুরু করে দিল, আমি কিভাবে যাব সেটা নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা নেই। এই মেয়েটা কারো ভাল মন্দ কোনো কিছুতেই তার মাথাব্যথা নেই, সব জায়গাতেই নীরব ভূমিকা পালন করে, মাঝেমধ্যে ভালো লাগে আবার মাঝেমধ্যে খুব অসহ্যও লাগে। যাইহোক খুব কষ্ট করে টেনে হেঁচড়ে কোনরকমে লাগেজটা লঞ্চে উঠালাম, হঠাৎ লক্ষ্য করে দেখলাম সেই লোকটা সেই তখন থেকেই ফোড়ন কেটে যাচ্ছে, ওমা তাও আবার আমাকে নিয়ে। লঞ্চের দোতলায় উঠলাম , মাঝামাঝি দুটো সিটে বসলাম, পিছন ফিরে দেখি পাশের সিটের সে দুটো লোক আমাদের পেছনে বসা। গায়ে পরা লোকটা আমাকে বলছে এত বড় ব্যাগ নিয়ে কেউ কোথাও যায়, আমাকে দেখেন যে ড্রেস পড়ে বের হয়েছি ওটা পরেই আবার ফিরে আসবো, কথাটা শুনে মেজাজটা খুব বেড়ে গেল। এমনিতেই মেজাজ গরম ছিলো, বলে উঠলাম আচ্ছা মশাই আপনার কি সমস্যা সেই তখন থেকে দেখছি বকবক করে যাচ্ছেন,আচ্ছা আপনি কি জানেন একটা ছেলের বাইরে বের হতে গেলে একটা প্যান্ট আর শার্ট হলেই হয়ে যায় আর একটা মেয়েকে বাইরে বের হতে হলে মিনিমাম পাঁচটা কাপড় পড়তে হয়।
তারপর রাগ হয়ে কামরা থেকে বের হয়ে গেলাম জানালার পাশে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মনের অনেক কষ্ট নদীর স্রোতের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছিলাম, কিছুক্ষণ পর আর ছেলেটিকে দেখা গেলোনা উধাও হয়ে গেল,কেন জানি হঠাৎ মনে হলো না যাত্রাপথে এরকম কাউকে পাওয়াতে ভালোই হয়েছে, খুনসুটি করে ভালই হচ্ছে সময়টাও পার হয়ে যাচ্ছে। মাইসা আমাকে বলছে, তোমাকে বললাম বাসায় কিছু কাপড়চোপড় রেখে আসো তাহলে আর খুলনায় গেলে ব্যাগ টানাটানির ঝামেলা থাকে না। আমি বললাম চুপ করবি একজন গেছে আর একজন শুরু হয়েছে। এইতো এখন বাসে উঠতে পারলেই ঝামেলা শেষ। তারপর তো বাসার কাছেই বাস থামবে। একটা রিক্সা নিয়ে বাসায় চলে গেলেই হল।লঞ্চেটা প্রায় ঘাটের কাছে চলে এলো, লঞ্চ থেকে নামার জন্য তৈরি সবাই, এক এক করে প্রায় সব যাত্রী নেমে গেছে। আমি একটু পেছনেই নামছি যাতে করে ভারী ব্যাগটা নিয়ে নামতে কোন রকম ঝামেলা পোহাতে না হয়। লঞ্চ থেকে নেমে কিছুটা জায়গা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়,আমি যখন সিঁড়ি দিয়ে উঠতেছি হঠাৎ চোখে এল একটা বৃদ্ধা মহিলা লাঠি ভর দিয়ে হাঁটতে পারছে না খুব কষ্ট হচ্ছে, কিভাবে উপরে উঠবে ভেবে পাচ্ছি না সঙ্গে তার মেয়ের জামাইও ছিল, কিন্তু তার দুহাতে ব্যাগ বোঝাই করা। মাইসাকে দেখলাম তার পাশ দিয়ে হইহই করে বেরিয়ে গেল। আমি ওই মহিলার হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানোর চেষ্টা করছি খেয়াল করিনি,একহাতে আমার ওই ভারি ব্যাগ অন্যহাতে আমি ওই মহিলাকে খুব সাবধানে উপরে উঠাচ্ছি,হঠাৎ করে ওই গায়ে পরা লোকটা কোথা দিয়ে উদয় হলো, কোনো কিছু না বুঝেই আবার ফোড়ন কাটল এতো ভারি ব্যাগ যা টানতে পারেন না তা নিয়ে বের হন কেন, আর মুখ বন্ধ করে রাখতে পারলাম না বলেই ফেললাম একটা মেয়ে এত ভারী একটা ব্যাগ টানছে তার উপর আরেকজনকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে আর আপনারা পুরুষরা পিছনে বসে মজা নিচ্ছেন,কোথায় একটা মেয়েকে সাহায্য করবেন তা বাদ দিয়ে সেই ধরে পেছনে লেগেই আছেন ,মেয়েদের কি অবলা মনে হয়, ছিঃ। এবার বোধহয় ছেলেটার টনক নড়লো, সাথে সাথে ছেলেটা বলে উঠলো, আরে না না আমি মেয়েদের অবলা মনে করিনা, আমি মেয়েদের সম্মান করি,সরি আমার ভুল হয়ে গেছে ,আপনি বোধহয় রেগে গেছেন, সরি।
আমি আর কোন কথা বাড়ালাম না রাগটা যেয়ে পড়ল মাইসার উপর , ওকে বললাম-এই তুই তো দেখলি ওই দাদীটা উপরে উঠতে পারছে না একা একা, একটু সাহায্য করলে কি এমন হত, ও বলল আমি খেয়াল করিনি। তারপর ওনাকে উপরে তুলে দিয়ে আমি আমার নির্দিষ্ট বাসে উঠে পড়লাম, সেই ছেলেটা আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়ে আবার বলল সরি ম্যাডাম আপনাকে হার্ট করতে চাইনি। তারপর সেও বাসে যেয়ে বসলো। বাসে উঠে খুব ক্লান্ত লাগছিল তাছাড়া দুপুরে কিছু খাওয়াও হয়নি দুজনার, কখন যেন দুজনে ঘুমিয়ে পড়েছি, গোপালগঞ্জের কাছাকাছি আসতেই ঘুমটা ভেঙে গেল, চোখ মেলে দেখি ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে, চোখে চোখ পড়তেই চোখটা সরিয়ে নিলেন, কিছুক্ষণ পর আমাকে বলছে আমি নিলয়,সাংবাদিক। আমি বলে উঠলাম তো আমি কি করতে পারি, মিষ্টি করে হেসে দিয়ে বললো আমি কি আপনার মোবাইল নাম্বারটা পেতে পারি, আমি জানিনা এভাবে আগে কখনো কাউকে মোবাইল নাম্বার দিয়েছি কিনা! বিনা দ্বিধায় ওনাকে আমার নাম্বারটা বলে দিলাম, উনি আমাকে বলল কোন সমস্যা নেই তো নাম্বার দিতে, আমি বললাম না কি সমস্যা ,আমার ভালো না লাগে আমি ফোন ধরবো না। আমার নাম্বারটা দিয়ে উনি আমাকে একটা মিস কল দিল, আর বলল আপনি নিলয় নামে সেভ করতে পারেন।আমি নাম্বারটা সেভ করলাম তবে নিলয় নামে নয় খাইষ্টা নামে, কেন জানি নাওনার নাম সঙ্গে এই খাইস্টা নামটা ভালো মিলে গেছে। আবার দুজনে চুপ করে গেলাম, কিছুক্ষণ পর নিলয় আমাকে জিজ্ঞেস করছে আপনার নাম কিন্তু জানা হল না।বরাবরের মতো আমি আমার পরিচয়টা দিয়ে দিলাম ,আমি হীরা ,খুলনার মেয়ে ,ঢাকায় থাকি খুলনাতে যাচ্ছি,সঙ্গে সঙ্গে নিলয় বললো আমি নড়াইলের ছেলে নড়াইল বেড়াতে যাচ্ছি চাকরিসূত্রে ঢাকায় থাকা হয়, নড়াইল বেড়াতে আসেন আমাদের সুন্দর একটা বাড়ি আছে গ্রামের ভেতর ছোট্ট বাড়ি, ছোট একটা পুকুর আছে, আসলে ভালো লাগবে। আমি বলে উঠলাম নড়াইল। আমিও নড়াইল আসবো, আমার বান্ধবীর বাড়ি।আমি ঢাকা থেকে খুলনাতে যাচ্ছি আমার বান্ধবীদের বাড়ি যাওয়ার জন্য। গোপালগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়িতে এসে বাস থামল।নিলয় নেমে যাচ্ছে। যাওয়ার সময় আমাকে বলল আসেন কফি খাই, যেহেতু দুপুরে আমরা দুজনেই কিছু না খেয়ে আছি। মাইসা বললো আমার খুব খিদে লেগেছে কিছু কিনে আনবা, তাই আমিও বাস থেকে নেমে এলাম, উনি আমাকে বললেন কই আসেন কফি খাই, আমি বললাম আপনি খেলে আমি খাওয়াতে পারে, তখন উনি আমাকে বললেন তাহলে আর খাওয়ার দরকার নাই আমি গেলাম। বলেই গটগট করে হেঁটে চলে গেল, আমি তাকিয়ে রইলাম লোকটা চলে যাওয়ার দিকে, হঠাৎ করেই মনে হলো তার সঙ্গে কি বেশি খারাপ ব্যবহার করে ফেললাম। কেন জানি বাসটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে,হয়তো নিলয় আর আমি- টম এন্ড জেরির মতো ঝগড়া করতে করতে এসেছি বলেই।
লেখক: নুরুন্নাহার হীরা, সহ-সম্পাদক, সময়প্রতিদিন