“সে”

Posted by

পর্ব: ০১

লাল মারুতি গাড়িটা শীতল অনুভূতি আর রবীন্দ্র সংগীতের লালিত মোহ নিয়ে ছুটে চলেছে শহর ছেড়ে দূরে। আজ “শাহ ফেব্রিক্স”এর কর্মচারীদের বেতনের দিন। সব ঠিক ছিল,জেসমিনের মন সুখস্বপ্নে কেমন তন্ময় হয়ে ছিল। চারিপাশে গাছের সারি সারি আয়োজন, পেছনে ফেলে আসা লোকেদের কলরব, আর বীরদর্পে লাল মারুতি গাড়িটা যখন শাহ ফেব্রিক্স এর গেট অতিক্রম করছিল, কর্মচারীদের সালাম, রেস্ট নেবার আলাদা রুম, ঘুরে ঘুরে তাদের প্রতিদিনের কাজ দর্শন সবটা মিলিয়ে জেসমিন ভুলে গিয়েছিল ” সে কোথাকার, এখানে তার পরিচয় কী”? বস খায়রুল সাহেবের হাত ধরে সে নেমেছিল লাল মারুতি গাড়িটা দিয়ে। খুবই নিম্ন পরিবারের পরিচয় বহন কারী জেসমিন তিন ভাই-বোনদের মধ্যে ছোট। বড় দুই ভাই অল্প বেতনের চাকরী করে, মা যখন যেখানে কাজ পায় করে,আর সে টেনেটুনে পড়াশুনা চালিয়ে যাবার ফাঁকে সদ্য এই চাকরীটায় জয়েন করেছে। বাবা ক্যান্সারের রোগী।

একটা ঘুপচি ঘরে ওদের বসবাস। বলা চলে জেসমিন মধ্যবর্তী সুন্দরী, অন্তত চেহারায় এক ধরনের আচ্ছন্নতা আছে, দরিদ্রতা আর কমনীয়তা এ দুটোর সমন্বয়ে বসদের এমন সে দেরকে পটিয়ে মাল ভেবে নিয়ে বগল দাবা করে নানান জায়গায় আর শারীরিক বিক্রিয়ায় বেশ ভালই কাজ চালিয়ে নেয়া যায় বলে খায়রুল সাহেবের বিশ্বাস। অন্তত বয়ে চলা খরস্রোতা জীবনের পীড়নে সঞ্জীবনী রসের মতো। জেসমিন নিজের হাত দিয়ে বেতন ভাগ বাটোয়ারা করে দিল। কিছুকিছু মালামাল চেক করলো, দুপুরে শহরতলীর টাটকা খাবারের স্বাদ পেল, “মন্দ না,মন্দ না- আহা সব ঠিক ছিল,শুধু এই বস টা যদি এ গল্পের নায়ক না হতো, আর সে রসখাদ্য”! একেবারে অপরাহ্নে তারা শহরে ঢুকবার ফিরতি পথ ধরল। বসের উষ্ণ হাতে জেসমিনের হাত পরস্পরকে যেন এক সান্ধ্যকালীন ভাবাবেগে জড়িয়ে ফেলছে,উত্তেজনাকর গান এক রকম অসহিষ্ণুতা তৈরি করছে,আলো -আঁধারে জেসমিনের মনে এক কষ্টের ঝড় তুলে দিয়ে গাড়ি ছুটছে।

মগবাজারের মোড়ে এসে গাড়িটা থামল। জেসমিনের বাসা কিছুটা হেঁটে গলির শেষ মাথায়। খায়রুল সাহেব বিদায় নিলেন। ও একরাশ ভাবনা নিয়ে বাসায় পোঁছে গেল। “কিরে মা আজ এত দেরি-বাবা খুব উৎকন্ঠার সাথে জিজ্ঞেস করলেন। না বাবা চিন্তা করোনা,অফিসে একটু চাপ ছিল। যা যা ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নে” “তুমি কেমন আছ বাবা? ভাল মা, যেমন ভাল থাকা যায়”। জেসমিন ব্যাগ রেখে ওয়াশ রুমে ঢুকে গেল। মা, ভাই এদের সবার সাথে সামান্য কথার ফর্মালিটিস মেইনটেইন করে জেসমিন শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে ও রাহাতের কথা ভাবতে লাগল। তারপর আবার মন থেকে এসব ভাবনা উড়িয়ে দিল। কাল অফিস ছুটি। কোচিং সেন্টারে টিচার নিয়োগের বিজ্ঞাপনে ও এ্যাপ্লাই করেছিল। কাল যেতে বলেছে। বিকেল তিনটায় ইন্টারভিউ।

জেসমিনের স্মার্ট ফোন নেই। বাটন ফোন,অহেতুক হাতটা রাহাতের নম্বরে যেয়ে ফিরে আসে,আবার মনকে জাগিয়ে তোলে। অবশেষে ফোনটা দিয়েই ফেলল। খুবই আস্তে আস্তে কথা বলতে হচ্ছে, রাহাতের সাথে শুধুই কুশল বিনিময় হলো। কত কথা ও বলতে চায়,কিন্তু কিছুই বলতে পারল না। “ভালবাসি তাতে কী, অধিকার নেই যে”-চিটচিটে বালিশ গড়িয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ল। ধীরে ধীরে ঘুমে জড়িয়ে নিল চোখ। আজ জেসমিন নিজে হাতে নাস্তা তৈরি করল, ভাইদের বেড়ে খাওয়াল, মা’কে ও পাশে বসাল। বাবাকে মুখে তুলে খাওয়াল, নিজেও একটু খেল। যে যার কাজে বেরিয়ে পড়লে বাসায় থাকল মেয়ে আর বাবা। পারত পক্ষে জেসমিন বাবার আশে পাশে খুব বেশি থাকেনা।এড়িয়ে চলে,বাবার দুখী দুখী মুখ দেখতে ওর কষ্ট হয়।

তাই কিছুটা পড়াশুনা করে,কিছুটা খায়রুল সাহেব কে ভেবে ভেবে ওর বাইরে বেরুবার সময় হয়ে গেল। বাসে করে খুব সহজেই ফার্মগেট এসে পৌঁছাল। ওর ইন্টারভিউ সময় আসতে আসতে সাড়ে চারটা বেজে গেল। যাবতীয় প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে ফেলল, ও বুঝল কোন কিছু হবে না। বাসায় যাবার জন্য লোকাল বাসের পথ ধরল। ঠিক অফিস ফেরত লোকদের যাবার সময় এটা, বেশ ভিড়,ধাক্কাধাক্কি, তবু জেসমিন চেষ্টা করছে,একবার বডি টা বাসে ঢুকিয়ে দিতে পারলেই হলো, কিন্তু না চেষ্টা করেও পারা যাচ্ছেনা। জেসমিন টের পেল পেছনে কার দু’টি হাত যেন ওর বুকের ওপর পাশ বেয়ে উঠে আসছে। কয়েক সেকেন্ডে মাথাটা হিম হয়ে গেল। পেছন ফিরে কোন নির্দিষ্ট লোককে ও আবিষ্কার করতে পারল না। না জীবনের সাথে ও আর আপোষ করতে পারছে না। সরে এল অনেক টা দূরে, চোখে জল গড়িয়ে পড়ছে, গা ঘিন ঘিন করছে। সন্ধ্যা শেষ শেষ,ও দাঁড়িয়ে আছে।হঠাৎ কাঁধে কার হাত- রাহাত তুমি! (চলবে)

লেখক: সুরাইয়া পারভীন।পরিচিতি: লেখক পেশায় একজন ব্যংক কর্মকর্তা। কবিতা লিখতে ভালবাসেন। অমর একুশে ২০২০ বইমেলায় লেখকের কবিতার বই প্রকাশ পায়। লিখছেন ছোট গল্প সমকালীন জীবনের ঘটনা নিয়ে।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*