লালমনিরহাটে ধর্মীয় সম্প্রীতির বিরল দৃষ্টান্ত,একই চত্বরে মসজিদ মন্দির। শত বছর ধরে চলছে দূর্গা পুজা

Posted by

জাহাঙ্গীর আলম শাহীন,লালমনিরহাট: শত বছর ধরে একই আঙ্গিনায় মসজিদ-মন্দির লালমনিরহাটে ধর্মীয় সম্প্রীতির বিরল দৃষ্টান্ত। প্রত্যহ সন্ধ্যায় নামাজের পর চলে পুজা অর্চণা। মহা সমারহে চলছে দূর্গাপুজা ও পাশেই মসজিদেও নামাজ। ধূপকাঠি ও আতরের সুঘ্রাণ মিশে একাকার। জেলা শহরে ধর্মীয় স¤প্রীতির এক উজ্জ্বল নিদর্শন একই আঙ্গিনায় মন্দির ও মসজিদ। এক পাশে উলুধ্বনি, অন্য পাশে চলছে আযান। এক পাশে ধূপকাঠি, অন্য পাশে আতরের সুঘ্রাণ। এভাবে ধর্মীয় স¤প্রীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে যুগ যুগ ধরে । পাশাপশি মসজিদ ও মন্দির পৃথক দু’টি ধর্মীয় উপাসনালয়। দেশের অন্য কোথাও আছে বলে জানা নেই। শত বছর ধরে যার যার মত ধর্ম পালন করে চলেছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় এই মন্দিরে শঙ্খ ধ¦নিবাজে, ঢাক ডোল পিটিয়ে হয় সান্ধ্যাকালীণ পুজা। একই সাথে মসজিদে প্রত্যহ সন্ধ্যায় মাগরিবের আযান হয়। মুসুল্লিরা জামাত করে নামাজ আদায় করে। কেউ কোনদিন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনে কারও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি। হয়নি কোন দাঙ্গা ফেসাদ। বরং দেশের কোথাও ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্টের ঘটনা ঘটলে এখানে হিন্দু মুসল্লিমরা এক সাথে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান দুইটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মহা সমারহে আনন্দমুখুর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল শারদীয় দুর্গোৎসব।
লালমনিরহাট শহরের পুরান বাজার। স্থানীয়রা যাকে কালীবাড়ি বলে ডাকে। এই কালিবাড়িতেই এক আঙিনায় অবস্থিত মসজিদ ও মন্দির। এখানে মুসলমানদের নামাজ পড়ার জন্য মসজিদ ও কালীবাড়ি দুর্গা মন্দির পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। দুটি স্থাপনার দেয়াল প্রায় লাগোয়া। এ যেন ধর্মীয় স¤প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ভোরে ফজরের সময় মোয়াজ্জিনের কণ্ঠে মিষ্টি আজান শেষে মুসলি­রা নামাজ আদায় করে চলে যায়। তার কিছুক্ষণ পরেই মন্দিরে শোনা যায় উলুধ্বনি ও শঙ্খ ধ্বনি। চলে পূজা-অর্চনার অনুষ্ঠানিকতা। একই ভাবে সন্ধ্যায় প্রত্যহিক মন্দিরে পুজা ও মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় হয়। মসজিদে সুগন্ধ চড়ায় আগরবাতি। একই ভাবে মন্দিরে সুগন্ধ ছড়ায় ধূপকাঠি। এমনই ধর্মীয় স¤প্রীতির অনন্য নিদর্শন বহন করছে শতবর্ষী মসজিদ ও মন্দির। মসজিদের মুয়াজ্জিন মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের এখানে একই উঠানে দুইটা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। এখানে মুসলমান এবং হিন্দুরা যে যার ধর্ম সুষ্ঠুভাবে পালন করছেন। আমরা নামাজ পড়ছি, তারা পূজা করছেন। কেউ কারো ধর্মে কোনো হস্তক্ষেপ করছে না। আমাদের মাঝে ধর্মীয় আচার-বিধি পালন করা নিয়ে কোনো দ্বন্দ নেই। কোন প্রতিবন্ধকতাও নেই। কোন ধর্মেও ধর্মপ্রাণ মানুষ এটাকে কোন সমস্যা মনে করে না। বরং এর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশ বিদেশে। এই ধর্মীয় নির্দশন এক নজর দেখতে এখানে প্রতিদিন কত মানুষ আসে। অনেকে মাগরিবের নামাজ পড়তে আসে বহুদুর হতে। তারা এখানে নামাজ আদায় করে নিজেরাই দেখেন মন্দিরের কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমস্যা হয় কিনা। তবে আমরা নিয়ম করে নিয়েছি। ইসলাম ধর্মে ৫ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ। মাগরিবের নামাজ দ্রæত আদায় করতে হয়। কারণ মাগরিবের সময় কেয়ামত নাজিল হবে। ইসলামে এই বর্ণনা আছে। তাই মাগরিবের আযান দেয়া মাত্র দ্রæত নামাজ আদায় হয়। নামাজ শেষ হলে পাশের মন্দিরে শুরু হয় প্রত্যহ পুজা অর্চনা। হিন্দু সম্প্রদায় এখানে উলুধ্বনি, শঙ্খ ও ঢাক ডোল পিটিয়ে ধর্মীয় সকল আনুষ্ঠানিকতা করেই পুজা করে। এভাবে সেই কবে হতে চলে আসছে কেউ বলতে পারেনা।
লালমনিরহাট জেলার জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এ্যাড. মোঃ মতিয়ার রহমান বলেন, ‘১৮৩৬ সালে দুর্গা মন্দির প্রতিষ্ঠার আগে এখানে কালী মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে পুরান বাজার অনেকের কাছে কালীবাড়ি নামে পরিচিত। এরপর মন্দির প্রাঙ্গণে ১৯০০ সালে একটি নামাজের ঘর নির্মিত হয়। নামাজের ঘরটিই পরবর্তীতে পুরান বাজার জামে মসজিদ নামে পরিচিতি লাভ করে।’ কালীবাড়িতে হিন্দু ব্যবসায়ীরা কালী মন্দির স্থাপন করে পুজা করে আসছিল। এক পর্যায়ে অনেক মুসলমান ব্যবসায় বাণিজ্যে চলে আসে। অনেকে ক্রেতা কালীবাজারে আসে। মুসলমানদের ওয়াক্তি নামাজ আদায় করতে মন্দিরের পাশে নির্মাণ করা হয় ওয়াক্তি মসজিদ। সেই থেকে এখানে মন্দিও ও মসজিদে পাশাপাশি ধর্মীয় এবাদত পালন হয়ে আসছে।
ঐতিহাসিকদের মতে, অবিভক্ত বাংলায় লালমনিরহাট ছিল খুবেই গুরুত্বপূর্ন একটা শহর। তার আগে মূগলসমাজ্যের সময় এটি খুবেই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছিল। তাই মূগলরা এই শহরের কয়েক মাইল অদুরে সেনা ছাউনি স্থাপন করে ছিল। সেই স্থানটির নাম মোগলহাট বলে পরিচিত। এখানে একটি পরিত্যক্ত রেল স্টেশন রয়েছে। বৃটিশরা এখানে ১৮৪২-৪৩ সালে দক্ষিণ এশিয়ার সেই সময় বৃহত্তম বিমান বন্দও স্থান করে। যাহা বিমান ঘাঁটি নামে পরিচিত। বৃষ্টিশ বেঙ্গল ডুয়াস কোম্পানি ১৮৮২ রেল লাইন স্থাপন করে। লালমনিরহাট হতে অসম, কুচবিহার ও করচি পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করে ছিল। এখনো রেললাইন গুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। রেল যোগাযোগের সুবিধায় লালমনিরহাট কালীবাড়ির ব্যবসাবাণিজ্যেও প্রাণ কেন্দ্র পরিণিত হয়। সেই সময়ের ব্যবসা বাণিজ্যে আদিক্ষতা ছিল হিন্দু মাড়য়াড়িদের। তারা শহরের কালীবাড়িতে বিশাল বিশাল নানা ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালিত করে আসছিল। সেই সময় এই লালমনিরহাটে ছিল যান্ত্রিক সরিষার তেলের মিল, বিশাল রাইচ মিলসহ নানা কলকারখানা। ছিল বিশাল বিশাল পাটের গোডাউন। দ্বিতীয় বিশ্বেযুদ্ধের পর ও ভারত বর্ষে হিন্দু মুসল্লিম দাঙ্গার পর মাড়যাড়ি ব্যবসায়ীরা এদেশ ছেড়ে ভারতে চলে যায়। আবার ভারত হতে মুসল্লিম পরিবার গুলো মাইগ্রেশন করে এখানে চলে আসে।
প্রতিবেশি লালমনিরহাট চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ্ইন্ডাষ্ট্রিজের সভাপতি জেলা আওয়ামীলীগের সহসভাপতি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোঃ সিরাজুল হক বলেন, ‘কোনো বিবাদ ও ঝামেলা ছাড়াই ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করে আসছে দুই স¤প্রদায়ের মানুষ। দুর্গাপূজার সময় ঢাক-ঢোল ও বাদ্যযন্ত্র নিয়ে সমস্যা হয় না। মসজিদ ও মন্দির কমিটির সদস্যরা বসে ঠিক করে নেন কখন কিভাবে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করা হবে। নামাজের সময় সব বাদ্য-বাজনা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ রাখা হয়। নামাজ শেষে মুসলি­রা দ্রুত মসজিদ ত্যাগ করে পূজারীদের সুযোগ করে দেয়। এটাই এখানে নিয়ম। দীর্ঘদিন ধরে একই উঠানে মসজিদ-মন্দির হলেও উভয় ধর্মেও মানুষ স¤প্রীতির বন্ধনে থেকে স্ব-স্ব ধর্ম পালন করে আসছেন। কিন্তু ধর্ম পালন নিয়ে কখনো কোনো বাক-বিতন্ডাও হয়নি বলে জানা যায়। শালীনতা বজায় রেখে একই উঠানে দীর্ঘদিন বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব পালন করে আসছেন উভয় ধর্মের মানুষ।
ধর্মীয় স¤প্রীতি কী, ধর্মীয় স¤প্রীতি কাকে বলে, তা কেমন হওয়া উচিত- তা জানার জন্য, দেখার জন্য সবার এখানে আসা উচিত বলে জানান। মন্দিরের পুরোহিত সঞ্জয় কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘মন্দিরে নিয়মিত পূজার্চনা হয়। আজান ও নামাজের সময় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার বন্ধ রাখা হয়। ধর্মীয় স¤প্রীতির বিঘœ ঘটে- এমন অবস্থা কোনো দিন সৃষ্টি হয়নি। বরং স্থানীয় মুসল্লিদের সহযোগিতা পেয়ে আসছি।’
উভয় ধর্মের বাসিন্দারা এটা নিয়ে গর্ব করেন।
লালমনিরহাট রেলওয়ের অবসর প্রাপ্ত কর্মকর্তা বীরমুক্তিযোদ্ধা আব্দুস ছালাম জানান, সেই পাকিস্তান আমলে রেলওয়েতে চাকরি করার সুবাদে এখানে বসবাস শুরু হয়। ধর্মীয় সম্প্রীতি আমাকে মুগ্ধ করেছে। শেসে এখানে স্ত্রী, সন্তানদেও নিয়ে স্থায়ী বসবাস শুরু করেছি। চাকুরি ও স্থায়ীবসবাসের সুযোগে আমি নিজেও তা লক্ষ্য করেছি। পৃথিবীজুড়ে চলমান সহিংসতা, সা¤প্রদায়িক সংঘর্ষের সংবাদের মধ্যে এমন দৃশ্য নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। একই আঙিনায় মন্দির ও মসজিদ স্থাপন করেছে ধর্মীয় স¤প্রীতির বিরল দৃষ্টান্ত।
তবে এই ধর্মীয় সম্প্রীতির বিরল দৃষ্টান্তটি এবছর একটু দৃষ্টি কটুতে পড়েেেছ। মসজিদ ও মন্দিরের খোলা চত্বরটি এতোদিন যাহা মসজিদ ও মন্দিরের চত্বর হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছিল তাহা ব্যক্তি মালিকার জমি। এবছর এই চত্বরের ব্যক্তি মালিকানা জমিটি ইট দিয়ে ঘিওে নিয়েছে জমির মালিক। তিনি তার ব্যক্তিগত প্রয়োজনে আর্থিক প্রয়োজনে জমিটি বিক্রি করবে বলে জানা গেছে। জমির মালিকানা নিশ্চিত করতে ও যারা জমি কিনবেন তারা কোন ঝুটঝামেলায় যাতে না পড়েন সেই কারণে জমির দখলে নিয়েছে। তাই এবারের মন্দিরে দূর্গা পুজা করতে আসা দর্শনার্থিরা একটু বেকায়দায় পড়েছেন। তবে লালমনিরহাট প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম শাহীন মনে করেন। ধর্মীয় এই সম্প্রীতি কে দৃষ্টিনন্দন করে রাখতে ও উভয় ধর্মেও মানুষের ধর্মীয় আচার আচরণ পালনের সুবিধার্থে মন্দিও ও মসজিদেও খোলা চত্বরটি মন্দির ও মসজিদ কতৃপক্ষের কিনে নেয়া উচিত। তাই সকলে মিলে আর্থিক সহায়তা দিয়ে এক কোটি টাকা সংগ্রহ করে জমিটি কিনে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান দুইটিতে দান করার আহবান জানান। এতে জমির মালিক রাজি আছেন বলে জানা যায়। জমির মালিক পক্ষের সূত্রে জানা গেছে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান দুইটি খোলা চত্বরটি কিনলে বাজার ধরের চেয়ে কম মূল্যে দিবেন বলে জানা গেছে।
এদিকে কয়েক বছর পূর্বে এই ধর্মীয় দৃষ্টান্ত নিজের চোখে দেখতে আমেরিকার প্রাত্তণ রাষ্ট্রদূত ডেন মর্জিনা এই মসজিদ চত্বর পরিদর্শন করে ছিলেন। মসজিদ ও মন্দিরটি ধর্মীয় সম্প্রীতির বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে দেশে বিদেশে সুপরিচিতি রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*