লালমনিরহাটের প্রত্যন্ত গ্রামীণ শিল্পীদের করোনা পরিস্থিতিতে ইউটিউব টিভি চ্যানেল নতুন উপার্জনের পথ খুলে দিয়েছে

Posted by

জাহাঙ্গীর আলম শাহীন, লালমনিরহাট: ইউটিউবে টিভি চ্যানেল, ভাওয়া গানের চ্যানেল ও মিউজিক চ্যানেল খুলে গ্রামের অবহেলিত নাট্য, সংগীত ও যাত্রা পাল্লার শিল্লীরা স্থায়ী আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছে। করোনা সংক্রামণ রোধে দেশে গণ জমায়েতের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ফলে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নাট্য, যাত্রা, সংগীত, ভাওয়াগান, কুশানগান, পালাগান নেটুগান, হিন্দু সম্প্রদায়ের শাস্ত্রিয় গান, কীর্তন, লালনগীতি, পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, মারফতি, কবিগান, জারিগান, সারিগানসহ সকল সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড কয়েক মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। এতে করে প্রত্যন্ত গ্রামীণ অঞ্চলের শিল্পীদের আয় রোজগারের পথ বন্ধ রয়েছে। কিন্তু তথ্য প্রযুক্তিন ব্যবহার, প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেটর সেবা পৌচ্ছে যাওয়া গ্রামীণ এই শিল্পীরা বিকল্প আয়ের পথ হিবেবে ইউটিউব চ্যানেলকে বেঁচে নিয়েছে। এই ইউটিউব চ্যানেলে প্রতিদিন গান আপলোড করে ইউটিউব টিভি চ্যানেলের আয় দিয়ে সংসার চলছে। প্রতিটি ইউটিউব চ্যালেন মালিক প্রতিমাসে তার চ্যানেলে বিজ্ঞাপন প্রর্দশনের ওপর আয় করছে। দেড় বছর আগে তৈরি একটি চ্যানেল গড়ে ৬০ হাজার টাকা হতে এক লাখ টাকা মাসে আয় করছে।
জেলার আদিতমারী উপজেলার কমলাবাড়ি ইউনিয়নের বামনের বাসা বাজারের কম্পিউটারের মাধ্যমে গান লোড ও রেকর্ড ব্যবসায়ী বকুল চন্দ্র বর্মন(২৮)। বিকল্প কর্মসংস্থান হিসেবে করোনা পরিস্থিতিতে গ্রামীণ শিল্পীদের মাসিক আয়ের পথ করে দিয়েছে। সে তথ্য প্রযুক্তি, ইন্টানেট, কম্পিউটার, সাউন্ড সিষ্টাম ব্যবহার করে একটি আধুনিক ষ্টুডিও তৈরি করেছে। এই ষ্টেডিওতে গ্রামীণ শিল্পীদের গান রেকর্ড করা হয়। পরে সেই রেকর্ডকৃত গানের সাথে মিল রেখে বিভিন্ন গ্রামীণ স্পটে গিয়ে গ্রামের নানা বয়সের শিশু, কিশোর, কিশোরী ও যুবতিদের মডেল বানিয়ে ভিডিও তৈরি করে। এসব ভিডিও ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করে অর্থ উপার্জন করছে। সে তার তৈরি গানের ভিডিও আপলোড করতে ইউটিউবে টিভি চ্যানেলে কুলেছে। তার টিভি চ্যানেলের নাম বিএস মিউজিক ভিডিও ষ্টেশন, বিএস মিউজিক ভাওয়াইয়া ষ্টেশন ও কমলাবাড়ি ইউটিউব টিভি।
এই সব টিভি চ্যানেলের যাত্রা শুরু হয় মাত্র দেড় বছর আগে। তার টিভি চ্যানেলে নিয়মিত গান আপলোড হয় শারীরিক প্রতিবন্ধী আপন গোসেন দুলাল(২৫) ও তার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্ত্রী শ্যামলী আকতার জবার(২২)। এই শারীরিক প্রতিবন্ধী গ্রামীণ শিল্পীর পরিবারে এক বছরের শিশু রয়েছে। আগে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান করে মাসে ১৫/২০ হাজার টাকা রোজগার হত। এই দিয়ে চলত সংসার। করোনার কারণে এখন কোন অনুষ্ঠন হয় না। ফলে আয় রোজগান বন্ধ হয়ে গেছে। এমন সময় আশার আলো হয়ে দেখা দেয় কমলাবাড়ি ইউটিউব চ্যালেনের মালিক। এই চ্যানেলের মালিক প্রতিমাসে ১০/১২ হাজার টাকা (আয়ের উপর নির্ভর করে) শিল্পী পরিবারকে মাসিক বেতন দিচ্ছে। বিনিময়ে এই শিল্পী পরিবার (স্বামী Ñ স্ত্রী) প্রতিদিন একটি করে বিভিন্ন মেজাজের ও আমেজের গান তার রেকডিং ষ্টুডিওতে রেকর্ড করে। টিভি চ্যানেলের মালিক ডিজে বকুল সেই গান গুলোর সাথে মিল রেখে গ্রামীণ দৃশের ও গ্রামীন বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষ, কিশোর কিশোরী ও শিশুদের মডেল মানিয়ে নাচের দৃশ্য ধারণ করে তার ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করে।
এই ইউটিউব চ্যানেলটিতে নিয়মিত গান করেন, স্থানীয় গানের শিল্পী শ্যামলী আক্তার জবা(২২), হরিপ্রিয়া রাণী(২১), পংকজ কুমার(১১), আপন হোসেন দুলাল(২৫) ও কমলাবাড়ি ইউটিউব চ্যানেলের মালিক ডিজে বকুল(২৩) নিজে। গানের শিল্পীদের পাশাপাশি এই ইউটিউব টিভি চ্যানেলটিকে ঘিরে ৭ জন বাদ্যযন্ত্রির স্থায়ী কাজের সুয়োগ তৈরি হয়েছে। এই ইউটিউব চ্যানেলের গান রের্কডিং করার সময় কি বোর্ড বাজান সঞ্জ কুমার(১৯), অক্টপেড বাজার শিক্ষক বাবুল বর্মন(৪৫), বাঁশের বাঁশি বাজান ভ’বেন চন্দ্র বর্মন(৩২), দোতরা বাজান কান্তে চন্দ্র বর্মন। এছাড়া বিভিন্ন সময় জেলঅর নানা প্রান্ত হতে তবলা, খনজনি, সেতার, হারমনি, একতারাসহ নানা বাদ্য যন্ত্রের বাদককে আনা হয়।
এই চ্যানেলে গানের মডেল ও কন্ঠ দিয়েছেন, ক্লোজাব ওয়ান তারকা পূর্ণ চন্দ্র। কুড়িগ্রাম ও বহিরাগত স্থানীয় জনপ্রিয় শিল্পী বাশরি(১৯) ও সুফিয়া(২৪)। এছাড়াও অনেক মৌসুমি শিল্পী গান গেয়েছেন। অনেক শিল্পী আছেন, বাড়িতে নিয়মিত সংগীত চর্চা করেন কিন্তু কোথাও গান করে না। অথবা কোথাও গান করার সুযোগ পায়নি। তারাও সখের বশে এখানে এসে গান করেন। তাদের গানও রেকর্ড করে ইউটিউব চ্যানেলে ছেড়ে দেয়া হয়।
কমলাবাড়ি ইউটিউব চ্যানেলে, ডিজে মিউজিক চ্যানেল, ভাওয়াইয়া ইউটিউব চ্যানেল, ষ্টুডিও, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, গানের বিভিন্ন সফওয়্যার, সাউন্ড সিষ্টেম ইকুপমেন্ট, বাদ্য যন্ত্র, ষ্টুডিওকে সাউন্ডপ্্রুফ, ভিডিও ক্যামেরা, ভিডিও এডিটিং সফওয়্যার ও ইনট্রোরিয়াল ডিজাইন করতে প্রায় ৮ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে হয়েছে। মাসে এই ইউটিউব চ্যানেল গুলি হতে ৬০ থেকে এক লাখ টাকা আয় হয়। শিল্পী, বাদ্যযন্ত্রবাদক, মডেল, ভিডিও চিত্রায়ণ পরিবহনসহ আনুসাঙ্গিক খরচ বাদ দিয়ে ইউটিউব চ্যানেলের মালিকের মাসিক আয় থাকে ২০ হতে ৩০ হাজার টাকা। এই আয় দিন দিন বাড়বে। ইউটিউব চ্যানেলের মালিক ডিজে বকুল জানান, গান বা অনুষ্ঠান দেখে কোন আয় হয় না। ইউটিউব চ্যানেলে আয় আসে বিজ্ঞাপন প্রচারের ওপর। যে ইউটিউব চ্যানেলের যত বেশি গ্রাহক সেই ইউটিউব চ্যানেলে তত বেশি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি গুলো বিজ্ঞাপন প্রচার করে। যত বেশি বিজ্ঞাপন প্রচার হবে। তত বেশি চ্যানেলের মালিক অর্থ উপার্জন করতে পারবে। এসব চ্যানেলের অর্থ ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে হয়। ইউটিউব চ্যানেলে একাউন্ট খুলতে হয়। ডলারে অর্থ পেমেন্ট হয়।
এই বিষয়ে রির্পোট করতে গিয়ে খোঁজ খবর নিয়ে দেকা গেছে। জেলার ৫টি উপজেলায় কমবেশি প্রায় ৫০টি বিভিন্ন নামে ইউটিউবে টিভি চ্যানেল খুলেছে গ্রামীণ শিল্পীরা। সব টিভি চ্যানেল গুলোকে ঘিরে শিল্পীরা পৃথক পৃথক একটি করে শিল্পীর গ্রæপ করেছে। এইসব টিভি চ্যানেলে কেউ ভাওয়াইযা গান, কেউ জারিগান, কেউ সারিগান, কেউ পল্লীগীতি, লালণগীতি, কুশান, পালা, যাত্রাপালা, নাটক, র্কীতন, হিন্দুধর্মীয় গানসহ একেকটি ইউটিউব টিভি চ্যানেল একেকটি বিষয় প্রচার করছে। সকলের আয় আবার এক নয়। কেউ কেউ অল্প আয় করছে। এখনো তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। তবে ইউটিউবে আয় করছে এধরণে কয়েকটি টিভি চ্যানেলের মধ্যে রয়েছে মোগলহাট ইউটিউব টিভি চ্যানেল, কাকিনা ইউটিউব চ্যানেল, তিস্তা ইউটিউব চ্যানেল, ধরলা ইউটিউব চ্যানেল, সানিয়াজান ইউটিউব চ্যানেল, তিনবিঘা ইউটিউব চ্যানেল, কুলাঘাট ইউটিউব চ্যানেল, সীমান্ত ইউটিউব টিভি চ্যানেল, সীমান্ত ইউটিউব রেডিও চ্যানেল ইত্যাদি।
তথ্য প্রযুক্তির সম্ভাবনাময় এই খাতটি বাংলাদেশ সরকারের এখনো নজরকারেনি। এই শিল্পে রয়েছে নানা প্রতিবন্ধীকতা। এখন পর্যন্ত ইউটিউব চ্যানেল খুলতে সরকার কোন নীতিমালা তৈরি করেনি। ইউটিউব চ্যানেল খুলতে ইউটিউবে একাউন্ট খুলতে হয়। এই একাউন্ট বাংলাদেশে খোলা যায় না। ভারতে খুলতে হয়। সেই জন্য ভারতীয় একাউন্ড হোল্ডারদের প্রযোজন পড়ে। তাদের সহায়তা নিয়ে একাউন্ট খুলতে হয়। তাই একাউন্ট খুলতে বাড়তি অর্থ দিতে হয়। ইউটিউব চ্যানেলের জনপ্রিয়তা ও প্রচার বাড়াতে প্রথম দিকে নিজের পকেটের অর্থ খরচ করে প্রমোট করতে হয়। তবে গ্রাহকরা সাবক্রোইব করবে। ইউটিউব কতৃপক্ষে শর্ত পূরণ হলে শুরু হয়ে যায় অটোমেটিক আয়। ইউটিউব বিজ্ঞাপন প্রচার হতে অর্থ আয় করে এই আয় চ্যানেল গুলোতে দিয়ে থাকে।
লালমনিরহাটে তথ্য প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার আগ্রহ আছে এমন একজন অধ্যাপক মোঃ জাকির হোসেন সামীম জানান, ইউটিউব বিশ^কে মানুষের হাতের মুঠোয় পৌচ্ছে দিয়েছে। নিত্য নতুন আধুনিক এ্যান্ডোয়েট মোবাইল ফোনের বদৌলতে ইউটিউব চ্যানেলের জনপ্রিয়তা এখন দিনদিন বাড়ছে। মানুষ এখন ঘরে বসে টিভি দেখার সময় নেই। এছাড়াও নিদিষ্ট সময়ে খবর শুনার সময় নেই। মানুষ দ্রæত তাৎক্ষণিক খবর চায়। তাই ইউটিউব চ্যানেলে তাৎক্ষণিক খবর পাওয়া যায়। যখন তখন অনুষ্ঠান দেখা যায়। এমন কী টিভির কোন অনুষ্ঠান আপনি সম্প্রচারের সময়, সময়ের অভাবে দেখতে পাননি। কিন্তু ঐ অনুষ্ঠানটি দেখার ইচ্ছা ছিল। এখন কোন অসুবিধা নেই। ইউটিউবে সার্চ দিলেই আপনি পুরোন সেই অনুষ্ঠান পেয়ে যাবেন। এমন কী এখন বিখ্যাত শিল্পীরা নিজেদের ইউটিউব টিভি চ্যানেলে গান, মুভিসহ নানা অনুষ্ঠান মুক্তি দিচ্ছে। আগের দিনের মত সিনেমা হলে মুভি মুক্তির অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে না। ইউটিউবে মুক্তির পর সিনেমা হলে ছবি মুক্তি পাচ্ছে। বাংলাদেশের বেশ কিচু জনপ্রিয় শিল্পীর নিজস্ব ইউটিউব টিভি চ্যানেল আছে। এবারে ঈদুল আযহায় বাংলাদেশি শিল্পীরা নিজেদের ইউটিউব টিভি চ্যানেলে ছবি সহ নানা অনুষ্ঠান মুক্তি দিয়েছে।
জেলার একটি বেসরকারি কলেজের কম্পিউটার বিষয়ের অধ্যাপক মোঃ মোস্তফা কামাল জানান, ইউটিউব শিল্পী ও সংস্কৃতি বিকাশে সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের উচিৎ খুব দ্রæত সিদ্ধান্ত নিয়ে ইউটিউবের জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করা। সেই সাথে ইউটিউব টিভি চ্যানেলের উদ্যোগতাগণ যাতে বাংলাদেশে ইউটিউবের এ্যাকাউন্ট খুলতে পারে তার ব্যবস্থা করা জরুরী। এতে ইউটিউবে চ্যানেল খুলতে অর্থ ও সময় হ্রাস পাবে। তবে সব জিনিসের খারাপ দিকও আছে। বিজ্ঞাণ মানুষের কল্যাণ ও অকল্যাণ দু’টিতেই ব্যবহার করা যায়। ইউটিউবে গুজব ছড়ানো যায়। অশ্লীল ভিডিও আপলোড করা যায়।
কমলাবাড়ি ইউটিউব চ্যানেলের মালিক ডেজি বকুল জানান, তার কমলাবাড়ি ইউটিউব চ্যানেলটি বেশজনপ্রিয় হয়ে উঠে ছিল। প্রতিমাসে এখন প্রায় ৬০ হাজার টাকা আয় হচ্ছিল। কিন্তু দুই মাস আগে রাশিয়ান এক হ্যাকার টিভি চ্যানেলটি হ্যাক করেছে। সরকারকে অনুরোধ জানান, ইউটিউব চ্যানেল একটি সম্ভাবনাময়ী কর্মসংস্থানের জায়গা। তাই এক্যাউন্ট খোলা ও হ্যাকিং বন্ধ করছে দ্রæত যেন, ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*